শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বিশ্বের অনেক শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। এই অবস্থায় তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শিশুর অপুষ্টির লক্ষণগুলো সময় মতো চিহ্নিত করে সঠিক প্রতিকার গ্রহণ করলে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলো এড়ানো যায়। এই নিবন্ধে আমরা শিশুর অপুষ্টির লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
শিশুর অপুষ্টির লক্ষণ (Symptoms of Child Malnutrition): লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার
শিশুর অপুষ্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য সঠিক পুষ্টি অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু অনেক শিশু বিভিন্ন কারণে অপুষ্টিতে ভোগান্তি পায়। অপুষ্টির লক্ষণগুলো শনাক্ত করে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে অপুষ্টিকে প্রতিহত করা সম্ভব। এই নিবন্ধে আমরা শিশুর অপুষ্টির লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করবো।
শিশুর অপুষ্টির লক্ষণসমূহ
শিশুর বয়সে অপুষ্টির লক্ষণগুলো লক্ষ করা যায় না বলেই এর চিকিৎসা বিলম্বিত হয়ে যায়। কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ রয়েছে যা সতর্ক হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এই লক্ষণগুলো হল:
- ধীর বিকাশ: অপুষ্টিগ্রস্ত শিশুরা বয়স অনুযায়ী উচ্চতা, ওজন এবং মাথার পরিমাপে পিছিয়ে থাকে।
- দুর্বলতা: অপুষ্টি থাকা শিশুরা অন্য শিশুদের তুলনায় অনেক বেশি দুর্বল থাকে। তারা খেলাধুলোয় আগ্রহ দেখায় না।
- অতিরিক্ত ঝাপসা: প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ঘুমোনো একটি স্বাভাবিক লক্ষণ।
- অনাকাঙ্খিত ওজন হ্রাস: যদি কোনো অসুস্থতা না থাকলেও ওজন কমে যায় তাহলে সতর্ক হওয়া উচিত।
- প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব: অপুষ্টির কারণে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে সে সহজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে।
- চামড়ার পরিবর্তন: ঘা-ফোসকা, শুকনো চামড়া অপুষ্টির জন্য দায়ী।
- মাথার চুল পড়া: প্রটিন ও ভিটামিনের অভাবে মাথার চুল প্রচুর পড়তে পারে।
যদি এই লক্ষণগুলোর যেকোনোটি লক্ষ্য করা যায়, তাহলে অবিলম্বে শিশুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
শিশুর অপুষ্টির কারণসমূহ
শিশুর অপুষ্টির পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। এগুলো হল:
পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব
যদি শিশুর খাদ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর উপাদান যেমন প্রটিন, ভিটামিন ও খনিজপুষ্টি না থাকে তাহলে তার শরীরে এসবের ঘাটতি হয়ে অপুষ্টি দেখা দেয়।
অপর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ
যদি শিশুটি প্রয়োজনের চেয়ে কম খায়, তাহলেও তার অপুষ্টি হতে পারে। একটি শিশুর ডাক্তার নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্যালরির প্রয়োজন থাকে।
অসুস্থতা
বিভিন্ন রোগ যেমন ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি শিশুর পুষ্টি অবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়াও জন্মকালে ওজন কম থাকা, হাঁপানি, ফুসফুসের সমস্যা ইত্যাদি অপুষ্টি ডেকে আনে।
দারিদ্র্য
দরিদ্র পরিবারের শিশুরা সাধারণত পুষ্টিকর খাদ্য সংগ্রহের সুযোগ পায় না। তাই তাদের মধ্যে অপুষ্টি দেখা দেয়।
মাতৃ অপুষ্টি
যদি গর্ভাবস্থায় ও স্তন্যপানকালীন সময়ে মায়ের পুষ্টিগত অবস্থা ভালো না হয় তাহলে সে নিজের শিশুকে পুষ্টিকর খাদ্য দিতে পারে না।
শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির লক্ষণ ও উপসর্গ:
লক্ষণ ও উপসর্গ | বর্ণনা |
---|---|
ক্লান্তি ও অবসাদ | অপুষ্টিতে ভোগা শিশুরা সাধারণত অত্যন্ত ক্লান্ত থাকে এবং খেলাধুলোয় আগ্রহ প্রদর্শন করে না। তারা সহজেই উদাসীন ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। |
খিটখিটে স্বভাব | অপুষ্টিতে ভুগছে শিশুরা সাধারণত খিটখিটে ও রেগে যাওয়ার প্রবণতা দেখায়। |
মনোযোগহীনতা | অপুষ্টির কারণে শিশুদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার ক্ষমতাও কমে যায়। |
শুষ্ক ও খসখসে ত্বক | অপুষ্টিতে ভুগছে শিশুদের ত্বক খুবই শুষ্ক ও খসখসে থাকে। |
মাড়িতে রক্তপাত | ভিটামিন সি এবং ক’র অভাবে মাড়িতে রক্তপাত হতে পারে। |
ক্ষুধামান্দ্য | অপুষ্টির কারণে শিশুরা খাওয়ার প্রতি আগ্রহ হারায়। |
কম শারীরিক বৃদ্ধি বা একদমই বৃদ্ধি থেমে যাওয়া | অপুষ্টিতে ভুগছে শিশুর লম্বায় ও ওজনের বৃদ্ধিও কমে যায় বা সম্পূর্ণ থেমে যায়। |
ফুলে যাওয়া পেট | প্রটিন ও ক্যালরির অভাবে পেট ফুলে যায় কিন্তু পুষ্টি পায় না। |
শিশুর অপুষ্টি দূর করার উপায়
শিশুর অপুষ্টি দূর করতে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে:
- শিশুকে অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ডাক্তার সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করবেন।
- শিশুকে প্রতিদিন প্রয়োজনীয় পরিমাণ ক্যালরি ও পুষ্টিকর খাদ্য দেওয়া উচিত।
- শিশুর জন্য প্রটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাংস, ডিম, দুধ, মাছ ইত্যাদি দিতে হবে।
- ফল, সবজি ও শাকসবজিতে ভিটামিন থাকায় এগুলো দিতে হবে।
- খনিজপুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার যেমন ডিম, মাছ, ফলমূল, দাল ইত্যাদি দিতে হবে।
- হাঁপানি, ডায়রিয়া ইত্যাদি রোগের চিকিৎসা সঠিকভাবে সম্পন্ন করা উচিত।
- মায়ের জন্যও পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস অবলম্বন করা জরুরি।
এই সব ক্ষেত্রে ডাক্তার ও পুষ্টিবিদের পরামর্শ মেনে চললে শিশুর অপুষ্টি দূর করা সম্ভব।
অপুষ্টি প্রতিরোধে খাবার:
খাবার গোষ্ঠী | বিবরণ |
---|---|
ফল ও সবজি | প্রত্যেক ঋতুর ফল ও সবজি খাওয়াতে হবে। প্রতিদিন কমপক্ষে দুইবার ফল ও সবজি দিতে হবে। |
দুগ্ধজাত পণ্য | দুধ, ক্ষীর, পানীর, দই ইত্যাদি দুগ্ধজাত পণ্য দিতে হবে। |
শর্করা জাতীয় খাবার | ভাত, রুটি, আলু ইত্যাদি শর্করাযুক্ত খাবার দিতে হবে। |
প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার | মাংস, মাছ, ডিম, দাল ইত্যাদি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে। |
পানি | প্রতিদিন কমপক্ষে ১.৫ লিটার পানি পান করতে হবে। |
তেল, চর্বি ও বাদাম জাতীয় খাবার | তেল, চর্বি ও বাদাম জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। |
অপুষ্টিতে ভুগছে শিশু? কিছু প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন: শিশুর কোন বয়সে অপুষ্টির ঝুঁকি বেশি?
উত্তর: 0-5 বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে 1-2 বছরের মধ্যে অপুষ্টি দেখা দেয় বেশি।
প্রশ্ন: কতদিনের মধ্যে অপুষ্টির লক্ষণগুলো চিহ্নিত করা যায়?
উত্তর: সাধারণত এক মাসের মধ্যেই অপুষ্টির লক্ষণগুলো চোখে পড়া শুরু হয়। তবে কিছু লক্ষণ যেমন হৃদপিন্ডের ক্ষতি বা মানসিক পিছিয়ে থাকা কয়েক মাস পর ধরা পড়ে।
প্রশ্ন: শিশুর অপুষ্টি কত দিনে সেরে যায়?
উত্তর: অপুষ্টির ধরণ, মাত্রা এবং বয়সের উপর ভিত্তি করে অপুষ্টি সেরে যাওয়ার সময় ভিন্ন হয়। সাধারণত 2-4 মাসের মধ্যে সঠিক চিকিৎসায় অপুষ্টি দূর হয়ে যায়।
সংক্ষিপ্তসার
শিশুর বয়সে অপুষ্টি তার শারীরিক ও মেনের বিকাশে বড় বাধা সৃষ্টি করে। তাই অপুষ্টির লক্ষণগুলো সময় মতো চিহ্নিত করে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস, ডাক্তারের পরামর্শ এবং সচেতনতাই শিশুদের অপুষ্টি থেকে রক্ষা করতে পারে।